বাড়ি ভাড়ার চাপে চ্যাপ্টা ভাড়াটিয়া
- আপলোড সময় : ২১-০১-২০২৫ ০৪:৫৬:০১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২১-০১-২০২৫ ০৪:৫৬:০১ অপরাহ্ন
* ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে নাগরিক জীবন
* প্রতি বছরের শুরুতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, আছে সাবলেট-মেসেও অস্বস্তি
রাজধানীতে জীবনযাত্রায় বিগত কয়েক বছরে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বছরের শুরুতেই একগাদা খরচের চাপ আসে জগদ্দল পাথরের মতো। বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনার খরচ বাড়েই। সঙ্গে যোগ হয় মূল্যস্ফীতি কিংবা ভ্যাট-ট্যাক্স, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়া, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা সংক্রান্ত কারণে অতিরিক্ত পণ্যমূল্য। তবে নগরজীবনে টিকে থাকার লড়াই নিয়ে ‘আড়ালে’ ঢাকা পড়ে আছে কত শত লাখো কোটি মানুষের হাসি-কান্নার গল্প। বেকার, ভাগ্যান্বেষী, বিদ্যান্বেষীসহ নানা প্রয়োজনে ক্রমেই ঢাকার জনসংখ্যা যেন বাড়ছেই। ফলে ‘ঢাকা’র সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি ‘থাকা’। এককথায় বলতে গেলে বাড়ি ভাড়ার চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে ভাড়াটিয়া।
জানা গেছে, মাত্র এক হাজার ৪৬৩.৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট এ শহরে ঘুমাতে হয় প্রায় দুই কোটি মানুষকে। গেল বছরের জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরের তালিকায় ৭ম স্থানটি দখল করেছে ঢাকা। আর ২০১৭ সালে জাতিসংঘের বসতি সংক্রান্ত উপাত্তের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা। বাসস্থানের সংকট ঢাকার এক অনিবার্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে গাদাগাদি করে বাস করাই গা-সওয়া হয়ে গেছে ঢাকার মানুষের। ঢাকা যেন তার নামের মতো করেই তার বাসিন্দাদের আবদ্ধ করে রেখছে। একদিকে সংকীর্ণ বাসস্থান অন্যদিকে উচ্চ ভাড়া এ দুই চাবুকের কষাঘাতে ঢাকাবাসী এখন হাঁসফাঁস করছে। তার ওপর প্রতিটি নতুন বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানোর খড়্গ মানুষকে অর্থনৈতিক নির্যাতনের মুখে ফেলেছে। ঢাকায় এখন এমন অনেক বাড়িওয়ালা আছেন যারা কর্মজীবনে অন্য কিছু করেন না। শুধু ফ্লাটের ভাড়া তুলে সংসার চালান। ফলে ফি বছর ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা চালান। তাদের এ চেষ্টা বহু মানুষের তেষ্টা লাগিয়ে দিচ্ছে।
ঢাকা শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়াটিয়া: ঢাকা শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। ফলে ঢাকা যেন এখন আধুনিক যাযাবরের শহরে পরিণত হয়েছে। আরব ভূখণ্ডের যাযাবরদের মতো করেই নিদারুণ কষ্টে বছর কাটে ভাড়াটিয়াদের। নির্দিষ্ট বাসভূমি না থাকায় বিড়ম্বনাই যাদের নিত্যসঙ্গী। বছর ঘুরলেই ভাড়া বাড়ে সেই সঙ্গে বাসা বদলের তাড়া বাড়ে ভাড়াটিয়াদের। ফলে সাধ্যের মধ্যে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে বছর বছর মানুষকে ঠিকানা বদলাতে হয়। বাসা বদলের যন্ত্রণা ও খরচ তাই ভাড়াটিয়াদের জন্য অত্যাচারের নতুন খড়্গ। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য এ শহরে আশ্রয় খোঁজা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। উচ্চবিত্তের জন্য সুরম্য অট্টালিকা ও বিলাসবহুল ফ্লাট যতটা তৈরি হচ্ছে বাকি দুই শ্রেণির জন্য ততটা নয়। ফলে উচ্চমূল্যের বহু ফ্লাট রাজধানীতে এখন ফাঁকা পড়ে থাকলেও সংকট রয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের থাকার জায়গার। আর তাই বছর ঘুরতেই নোটিশ ঝোলে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির। নিরুপায় ও বাধ্য হয়েই এ দুই শ্রেণির মানুষকে অনেকটা যাযাবরের মতো করেই বাসস্থান বদলাতে হয়। অথচ বাসস্থান প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই বিষয়ে লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের আবাসনের কথা বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১৫ক)। সংবিধানেরে এ নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের জাতীয় গৃহায়ণ নীতিতে সাধ্যের মধ্যে সবার আবাসনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে, বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য। কিন্তু দেশের রাজধানী শহর ঢাকায় এখন সবচেয়ে বেশি আবাসন সংকটে রয়েছে এ দুই শ্রেণির মানুষ।
আয় অনুযায়ী যেসব বাসায় থাকেন ভাড়াটিয়ারা: রাজধানীর ডেমরা-যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শ্যামপুর, খিলগাঁও, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, মিরপুর, গুলশান, বনানী ও উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০ হাজার টাকা আয়েও থাকতে হচ্ছে ঝুপড়ি ঘরে। অর্ধলাখ টাকা আয় না হলে মানসম্মত আবাসনে থাকার ব্যবস্থা নেই। গবেষণাটি পরিচালনা করেছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেটস অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন বা রিহ্যাব। রিহ্যাব গবেষণা সেলের তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকায় যাদের আয় ২০ হাজার বা ২০ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ভরসা তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার কোনো ঝুপড়ি ঘর। এ ঘরে পরিবার নিয়ে কোনোরকমে থাকছেন তারা। যাদের আয় ২১ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা তারা থাকছেন ছয় থেকে ১০ হাজার টাকায়, সাবলেট। ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকা যাদের আয়, তারা থাকছেন ছোট আকারের কোনো ফ্ল্যাটে। যেগুলোর ভাড়া ১১ থেকে ১৪ হাজার টাকার মধ্যে। যাদের আয় ৪১ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে তারা থাকছেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ফ্ল্যাটে। যেগুলোর আয়তন ১১০০ থেকে ১১৫০ বর্গফুট। ৫১ থেকে ৮০ হাজার টাকা আয়ের মানুষের ভরসা ১১৫০ থেকে ১২০০ বর্গফুটের কোনো ফ্ল্যাট, যেগুলোর ভাড়া ২১ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। ৮০ থেকে এক লাখ টাকা আয়ের মানুষ থাকছেন ১২০০ থেকে ১৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে- যেগুলোর ভাড়া ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে। তবে ভালো মানের ১৫০০ বর্গফুট বা তারচেয়ে একটু বড় কোনো বাসায় থাকতে হলে অবশ্যই একলাখ টাকার বেশি তাকে আয় করতে হবে। যেগুলোর ভাড়া ৪০ হাজার টাকা বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি।
রাজধানীতে ‘বউ’ না থাকলে বাসা মেলে না: ঢাকায় কান্না চাপা জীবনের নাম ব্যাচেলর। অবিবাহিত ছেলে বা মেয়েদের বাসা ভাড়া দিতে চান না অধিকাংশ বাড়ির মালিক। ফলে ঢাকায় পরিবার নেই এবং অবিবাহিত এমন শিক্ষার্থী বা কর্মজীবীদের বাড়ি ভাড়া পাওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ডুমুরের ফুল। অধিকাংশ পুরুষ ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে শুনতে হয়, বউ না থাকলে বাসা ভাড়া দেয়া হবে না। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ হল বা ছাত্রাবাসে থাকে। আর বাকি ৮৫-৯০ শতাংশই (আনুমানিক ২০ লাখ শিক্ষার্থী) বাইরে বাসা ভাড়া করে থাকে। আর বিভিন্ন সরকারি-রবসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এমন ব্যাচেলরদের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। সঙ্গে ব্যাচেলর গার্মেন্টকর্মী আছেন ৬-৭ লাখ। সব মিলিয়ে প্রায় ৬০ লাখ ব্যাচেলর থাকেন রাজধানীতে। এ বিপুলসংখ্যক ব্যাচেলরের থাকার জায়গা নিয়ে এক কঠিন জীবনযুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। অধিকাংশ ব্যাচেলরদের ভরসা হয়ে ওঠে বিভিন্ন বেসরকারি বাণিজ্যিক হোস্টেল ও মেসে। সেখানেও ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। বিশেষ করে রাজধানীর ফার্মগেট ও তার আশপাশের এলাকায় এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকে বাসা ভাড়ার হার বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। এ বিষয়ে প্রশাসনের কোনো মনিটরিং নেই।
অন্যদিকে মেয়ে ব্যাচেলর বা অবিবাহিত মেয়েদের জন্য বাসা পাওয়া আরও ভোগান্তির ব্যাপার। ছেলে ব্যাচেলরদের সব ভোগান্তিই মেয়ে ব্যাচালরদের সঙ্গী, সঙ্গে নিরাপত্তা সংকট উপরি পাওনা। যেসব বাসাতে মেয়ে ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়া হয় সেখানে থাকে সান্ধ্য আইনও। সন্ধ্যার পর তাদের চলাচলে আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। ফলে যেসব শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভিনিং মাস্টার্স করেন কিংবা যাদের অফিস রাত ৮টায় শেষ হয় তাদের এ শহরের বাঁকে বাঁকে থাকা যানজট ছাড়িয়ে বাসায় ফিরতে অনেক সময়ই ৯টা বা ১০টা বেজে যায়। এমন মেয়ে ব্যাচেলরদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ শোনার মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হয় যখন তখন। তবে বাড়িওয়ালাদের অভিযোগ, ব্যাচেলররা ফ্ল্যাট নষ্ট করে ফেলেন। তারা বাড়িঘরের যত্ন নেন না। এসব কারণে বাড়িওয়ালারা ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতে চান না।
ব্যাচেলর ও বাড়ির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনা বেশ পুরনো হলেও সেই বিড়ম্বনাকে চরম মাত্রা দিয়েছে জঙ্গি আতঙ্ক। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে কয়েকজন তরুণ জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটালে বাড়ির মালিকদের মধ্যে ‘ব্যাচেলর খেদাও’ মনোভাব দেখা যায়। ওই হামলার পর বহু বাড়ির মালিক ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়ার ইতি টেনেছেন। এ ছাড়াও হতাশা কিংবা প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যার প্রবণতাও তরুণদের মধ্যে বেশি থাকায় ব্যাচেলরদের ঠাঁই দিতে চান না বাড়ির কর্তারা। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ মেস সংঘ দাবি জানিয়েছে, শহরে বসবাসরত ‘ব্যাচেলর’ ভাড়াটিয়াদের আবাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারিভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা, ‘ব্যাচেলরদের’ হয়রানি এবং বাড়ির মালিকদের ভাড়া বাড়িয়ে অর্থনৈতিক নির্যাতন ও উচ্ছেদ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
মেসেও মিলছে না স্বস্তি: সুমাইয়া আক্তার পাখি, ধোলাইখাল এলাকায় একটি মেসে থাকেন। পড়াশোনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিউশনি করার পাশাপাশি একটি কোচিং সেন্টারেও খণ্ডকালীন চাকরি করেন। চারজন মিলে এক রুমের মেসে থাকছেন। খাওয়া ও মেসভাড়া বাবদ মাসে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা চলে যায়। তার মাসিক আয় গড়ে সাত হাজার টাকার কিছু বেশি। তিনি বলেন, একটা সময় ছিল পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে সব খরচ হয়ে যেত। হাতে বাড়তি দেড়-দুই হাজার টাকা থাকতো। এখন মাস যায়, খরচ বাড়ে। মালিক ভাড়া বাড়িয়েছেন, এতে এক ধাপে মেস খরচ ৫০০ টাকা বেড়েছে। চাল-তেলের দামও বাড়তি। এখন সব খরচ শেষে আর হাতে টাকা থাকে না। সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্র নাসিরুল ইসলাম থাকেন লালবাগ এলাকার একটি মেসে। একটা সময় বাড়ি থেকে টাকা এনে পড়াশোনা চললেও প্রায় তিন বছর ধরে নিজের টাকায় চলতে হয়। পার্টটাইম চাকরির পাশাপাশি চলছে চাকরির পড়া। মেসের ভাড়া, খাবার খরচ জোগাতে এখন চাইলেও ভালো খাবার বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না তার। নাসিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের সব কিছুর দাম বেড়েছে দেখে মেসের মালিক নিজেই মেসের ভাড়া বাড়িয়েছেন। আগে মেসের ভাড়ার সঙ্গে পানি-বিদ্যুৎ থাকলেও এখন আলাদা করে আরও ৫৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বাড়ি থেকেও টাকা নিতে পারি না, আবার আয়ও বাড়েনি। চাইলেও বাড়তি কাজ করতে পারছি না, চাকরির প্রস্তুতির কারণে। সবমিলিয়ে একটা কঠিন সময় পার করছি।
বেতনের অর্ধেক যাচ্ছে বাড়ি ভাড়ায়: আইনের প্রয়োগ না থাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাড়াবাড়ির শেষ নেই। ফলে বাড়ি ভাড়ার চাপে চ্যাপ্টা হচ্ছেন ভাড়াটিয়ারা। মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা বেতন পান এমন আয়ের মানুষদের বেতনের অর্ধেকটাই চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ফলে পরিবারের সদস্যদের অনান্য চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের। খরচ কমাতে অনেকেই কর্মস্থল থেকে বেশ দূরে বাসা নিয়ে থাকেন। ফলে ঢাকার সামগ্রিক যানজট যেমন বাড়ে তেমনি বাসা দূরে হওয়ায় আয়ের একটা অংশ খরচ হচ্ছে যাতায়াত বাবদ। তেমনি একজন সোহরাব হাসান। তার কর্মস্থল গুলশান হলেও তিনি বাসা নিয়েছেন কর্মস্থল থেকে বেশ দূরে মোহাম্মাদপুরে। মাসে ১৬ হাজার টাকা টাকা শুধু বাড়িভাড়া বাবদই গুনতে হয় তাকে। সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাস ভাড়া নিয়ে তা আরও ১৫০০ টাকার মতো বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজধানীতে দু’রুমের একটি মোটামুটি মানের ফ্লাটে থাকতে এখন ১৫-২৫ হাজার টাকা গুনতে হওয়ায় তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে অনান্য ক্ষেত্রে। এর ফলে কম আয় করা বাবার সন্তানেরা ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, বঞ্চিত হচ্ছেন ভালো খাবার, সময়মতো চিকিৎসা ও বিনোদন থেকেও। আর এ বাড়তি বাড়ি ভাড়ার চাপে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। বেসরকারি চাকরিজীবী মাহমুদ হোসেন বলেন, কদিন আগে গ্রামের বাসায় কিছু টাকা দিয়েছি বোনের বিয়েতে। এখন বাচ্চার স্কুলে ভর্তিসহ নতুন বাসার খরচ রয়েছে। হাতে নগদ অর্থ নেই, সামান্য সঞ্চয় রয়েছে সেটা ভেঙে খরচ করতে হবে। কেউ অসুস্থ হলে তো ঋণ করা ছাড়া উপায় নেই। বছরের শুরুতে এমন চাপে পড়েন অধিকাংশ চাকরিজীবী। স্কুলে ভর্তিতে বড় একটি টাকা চলে যায়। সঙ্গে থাকে স্কুলের জুতা, ইউনিফর্ম, ব্যাগ, স্টেশনারি, টিফিন বক্স ইত্যাদি কেনার খরচ। বাড়িভাড়ার চাপ তো আছেই। নতুন বছর উদযাপনটাও হয়ে ওঠে না অধিকাংশ মানুষের। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাব্বির আহমেদেরও একই অবস্থা। তিনি বলেন, গত বছরের শুরুতে বাসা সংস্কার করার অজুহাত দেখিয়ে এক হাজার টাকা বাড়িয়েছিলেন মালিক। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মালিকের ভাই জানিয়েছেন নতুন বছর থেকে আরও দেড় হাজার টাকা ভাড়া বেশি দিতে হবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটেই এ নিয়ে নোটিশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, কথা বলতে গেলে মালিক বলেন না পোষালে বাসা ছেড়ে দিতে। মানে ভাড়া বাড়ানো হবে মালিকের ইচ্ছায়। কথাও বলা যাবে না। বাসা ছাড়তেও পারছি না, কারণ বাচ্চাদের স্কুল বাসার কাছে। দূরে বাসা নিলে তাদের জন্য নতুন স্কুলে ভর্তিসহ বাড়তি পরিবহন খরচ লাগবে। সঙ্গে নিত্যপণ্যের দামও নাগালের বাইরে। কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারছি না, আবার জীবিকার তাগিদে এ শহরও ছাড়তে পারছি না। তবে ভাড়া বাড়লেও বাড়ির মালিকরা বলছেন উল্টো কথা। তারা এর পেছনে নানান সংস্কারসহ বিভিন্ন বিলের ইস্যু নিয়ে আসছেন। মগবাজার চান বেকারির গলির বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার মেইনটেন্যান্স খরচ বেড়েছে। নিরাপত্তা প্রহরীদের বাড়তি খরচ না দিলে থাকবে না। সব মিলে আমাকেও চলতে হবে। একই কথা বলেন ব্যাপারী গলির বাসামালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রিপন। তিনি বলেন, কদিন আগেই গ্যাস লাইন মিটারে কনভার্ট করলাম, বিদ্যুতের কাজও চলমান। বাসার কিছু সংস্কার করেছি। আমার বাড়তি আয় নেই। বাসাভাড়ার ওপরেই চলতে হয়। তাহলে এই বাড়তি অর্থ কোথায় পাবো?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন বলছে, দেশের সিটি করপোরেশনগুলোতে বসবাসকারীদের মধ্যে ৭২ শতাংশই ভাড়া বাসায় থাকেন। এসব এলাকায় নিজের বাসায় থাকেন মাত্র ২৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ মানুষ। সিটি করপোরেশনের বাইরে অন্য শহরে ভাড়ায় থাকেন ১৮ শতাংশ। তবে বিবিএসের তথ্য আরও বলছে, দেশে বাসাভাড়াও বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে শহরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন। যার মধ্যে গ্রামে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, শহরে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ আর সিটি করপোরেশনে ৭২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। দেশে ভাড়া ছাড়াই থাকেন ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ মানুষ। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে ২০২৫ সালে বাড়িভাড়া বাস্তবায়ন ও স্বাভাবিক রাখার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেস সংঘের (বিএমও) মহাসচিব মো. আয়াতুল্লাহ আকতার। তিনি বলেন, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী, শিক্ষার্থীরা প্রতি নতুন বছরে বাসাভাড়া নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। তাদের আয়ের সিংহভাগ বাসাভাড়ায় চলে যায়। নতুন বছরে লাগামহীন বাড়িভাড়া বাড়ানো কারও কাম্য নয়। অযৌক্তিকভাবে কোনো অবস্থায়ই বাড়িভাড়া বাড়ানো যাবে না। বাড়িভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রতিপালন করতে হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ